স্পেন দেশের সাহিত্যে গত পঞ্চাশ বছরেরও বেশি সময় জুড়ে যে বিষয় ঘুরে ঘুরে এসেছে তা হল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এবং গৃহযুদ্ধ। বিশেষ করে জেনারেল ফ্রাঙ্কোর মৃত্যুর পরে স্পেন যখন ৩৬ বছরের দীর্ঘ অভিশাপগ্রস্ত একনায়কতন্ত্রের কবল থেকে অবশেষে মুক্তি পেল তারপর থেকে পূর্ণ উদ্যমে শুরু হয়েছিল সে দেশের সাহিত্যিকদের আত্মখনন এবং আত্মআবিষ্কার। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ইওরোপের ভাষাগুলিতে রচিত সাহিত্যের আমূল মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু সব দেশের মধ্যেও স্পেনের প্রেক্ষিতটি বিশেষ গুরুত্বের দাবী রাখে এ কারণেই যে সে দেশে একটি আত্মধ্বংসকারী গৃহযুদ্ধ ঘটেছিল। ১৯৩১ সালে রিপাবলিকান দল স্পেনে নির্বাচিত হওয়ার পরে বেশ কয়েকটি সংস্কারের কথা ঘোষণা করে। যার বিরোধিতায় ১৯৩৬ সালে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচিত রিপাবলিকান নেতাদের বিরুদ্ধে জাতীয়তাবাদী পার্টির নেতা জেনারেল ফ্রানসিস্কো ফ্রাঙ্কো এবং এমিলিও মোলার নেতৃত্বে একটি বিরোধী আন্দোলন শুরু হয়। ক্যাথলিক ধর্ম প্রচারক গির্জা এবং ইতালি, জার্মানি প্রভৃতি দক্ষিণপন্থী ইওরোপীয় শক্তিগুলি এতে খোলাখুলি ইন্ধন জোগায়। এদিকে দেশের ভিতরে বার্সিলোনা প্রভৃতি প্রদেশে মালিকের একপেশে শ্রম আইনের বিরুদ্ধে শ্রমিক শ্রেণী ধর্মঘট ডাকতে শুরু করে, গির্জাগুলির জনবিরোধী কার্যকলাপের বিরুদ্ধে বিক্ষিপ্ত আক্রমণ শুরু হয়। ’৩৬-’৩৯ তিন বছরের এই অন্তর্দ্বন্দ্বে দেশটি বিদীর্ণ হয়ে যায়। যার ফল স্বরূপ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শুরু থেকেই স্পেনে ফ্রানসিস্কো ফ্রাঙ্কোর একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয় কয়েক দশক জুড়ে, যার অবসান হয় ১৯৭৫ সালে তার মৃত্যু হওয়া পর্যন্ত। রক্তক্ষয়ী এই গৃহযুদ্ধে তিন বছরে অন্ততঃ সাড়ে তিন লক্ষ মানুষ নিহত হয়। পাঁচলক্ষের বেশি মানুষ পাকাপাকি ভাবে দেশ ছেড়ে পলাতক হয় যাদের অধিকাংশই বিভিন্ন লাতিন দেশে আশ্রয় নেয়। প্রথম দুই দশকে অর্থনৈতিক সংকট চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছলে অন্ততঃ এক লক্ষ মানুষ অনাহারে মারা যায়। পরবর্তীকালে মুক্ত অর্থনীতির সূচনা করে দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি ফ্রাঙ্কো সামলে উঠেছিল ঠিকই, কিন্তু মানুষের বিশেষ করে নারীর ব্যক্তিস্বাধীনতা বিলুপ্ত হয়েছিল তার আমলে। বিরোধী মত সম্পূর্ণ নিষেধ ছিল। কিন্তু সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব সম্ভবত পড়েছিল মানুষে মানুষের সম্পর্কের বুনোটে। স্পেনীয় পরিবারগুলি বহুধা বিভক্ত হয়ে গিয়েছিল এবং নিজেদের মধ্যে গভীর ঘৃণা ও বিরক্তির উন্মেষ ঘটেছিল। পারস্পরিক দোষারোপ, প্রজন্ম বাহিত ঘেন্নার ভার এই একবিংশ শতকের স্পেনেও বিপুল ভারী।
উপন্যাসের শুরুতে নায়ক ফিদেল, রামোনা পিসির নাতি তার পরিবারের গ্রামের বাড়িতে আসে। উদ্দেশ্য '৩৬ সালের যুদ্ধে নিহত ও নিখোঁজ কয়েকটি শব দেহের অনুসন্ধান করা। তার একটি থিসিস লেখার জন্য এই তথ্যগুলি জরুরী। মূলতঃ সে গবেষণা করছে প্রথম কার্লোস যুদ্ধের সঙ্গে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে ঘটে যাওয়া স্পেনের গৃহযুদ্ধের তুলনামূলক পরিস্থিতি নিয়ে। এবং গ্রামে এসে সে জানতে পারে গৃহযুদ্ধে প্রয়াত তার সেইসব আত্মীয়দের মৃতদেহ নাকি মোন্তিয়েচোর গহবরে ছুঁড়ে ফেলে দেয়া হয়েছিল। সেটির সত্যতা অনুসন্ধানে নায়ক ফিদেল উদ্যোগী হয়।
এই বিষয় নির্বাচনই মারিয়া মেরিনোর মুন্সিয়ানার পরিচয় দেয়। গত ৫০ বছর গৃহযুদ্ধকে ঘিরে বেশ কিছু অসাধারণ অনুসন্ধানমূলক উপন্যাস স্পেনে লেখা হয়ে গিয়েছে। আলমুদেনা গ্রান্দেসের বিখ্যাত Los Pacientes de Doctor Garcia ডঃ গারসিয়ার রোগীরা কিংবা খাভিয়ের Soldados de Salamina সালামিনার সৈনিকেরা উপন্যাস দুটি এর উজ্জ্বল উদাহরণ। এই উপন্যাসটিতে এক ঐতিহাসিক ভ্রমণানুসন্ধান ঘটিয়েছেন লেখক। এমন নয় যে তিনি কোন নির্দিষ্ট সিদ্ধান্তে পৌঁছতে চেয়েছেন।
এই উপন্যাসটিতে হোসে মেরিনো প্রথম কার্লোস যুদ্ধের সঙ্গে এই গৃহযুদ্ধের তুলনামূলক দৃষ্টি আনলেন যেটি বিশেষ কৌতূহলের জাগায়। এখানে এক টুকরো ইতিহাস বলে রাখি। গৃহযুদ্ধের ঠিক একশ বছর আগে আরো একটি গৃহযুদ্ধ ঘটেছিল। ১৮৩৩ সালে রাজা সপ্তম ফার্দিনান্দ প্রয়াত হলে, ফ্রান্সের বুরবোঁ বংশের রাজা কার্লোস ইসিদ্রো পর্তুগাল থেকে স্পেনের শাসনভার নেবার ঘোষণা করে দেন। ইতিমধ্যে স্পেনের রানী হন দ্বিতীয় ইসাবেল। তিনিই উত্তরসূরী রাজা সপ্তম ফার্দিনান্দের। ওদিকে কার্লোসের অনুগামীরা "ঈশ্বর, পিতৃভূমি ও রাজা" এই শ্লোগান তোলে। তারা ঐতিহ্যশালী রাজতন্ত্রের এবং গির্জার কর্তৃত্বময়তার সমর্থক ছিল। উল্টোদিকে ইসাবেলের অনুগামীরা লিবারাল ছিল, এবং তারা ছিল এর বিরোধী। ঊনিশ শতকে স্পেনের প্রেক্ষিতে ‘লিবারাল’ যাদের বলা হত তাঁদের ধারণার সঙ্গে বর্তমানে লিবারাল বলতে যা বোঝায় তার কোন সম্পর্ক নেই। সমস্ত গবেষণা বলছে সেসময় এই কার্লোসপন্থীরা ছিল সংখ্যায় বেশি। সেই গৃহযুদ্ধেও তাদেরই বিজয় ঘটে। যার প্রভাব বিশ শতকের গৃহযুদ্ধেও ছিল। এরা এইসময় ঐতিহ্যপন্থী অর্থাৎ রক্ষণশীলপন্থী হওয়ার কারণে ১৯৩৬ সালের গৃহযুদ্ধে জেনারেল ফ্রাঙ্কোর দল এ অংশ থেকেই সমর্থন পেয়েছিল। এই বংশ পরম্পরায় বয়ে যাওয়া ধারণা, রাজা ও গির্জার যৌথ শাসন, গির্জার কর্তৃত্ব, রাজার সর্বময়তা …এই সমস্ত জটিলতা না বুঝতে পারলে এই উপন্যাসের মর্ম গ্রহণ করা কঠিন।
নায়ক ফিদেলের চরিত্রটি সে অর্থে কোন শ্রেণির প্রতিনিধিত্ব করে না। শৈশবে অনাথ ছেলেটি মানুষ হয় মামাবাড়িতে। সেখানে মামাতো বোনের সঙ্গে হওয়া তার প্রথম যৌন অভিজ্ঞতা সেখান থেকে সরিয়ে নেয় দাদুঠাকুমার কাছে। কিন্তু সেখানেও সে থাকতে পারে না। শেষ পর্যন্ত তাকে একলা থাকতে হয় বয়ঃসন্ধি পার করেই। ক্রমে পাঠক জড়িয়ে পড়তে থাকে এক জটিল কথোপকথনে। রাজনীতি ও সামাজিক অবস্থান জড়িয়ে থাকার কারণে একরকম জিজ্ঞাসাবাদ চলতে থাকে। বিভিন্ন ঘটনার কথা উল্লেখ করে প্রশ্নোত্তরের কাঠামোয় লেখক খুঁজতে চেষ্টা করেন এই গৃহযুদ্ধের গৃহে ভাল ও মন্দের তফাৎ কতখানি স্পষ্ট ছিল? যে প্রেক্ষিতে ১৮৩৩ এ কৃষক শ্রেণীকে যারা সমর্থন করেছিল কার্লোস যুদ্ধে তারাই কী ভাবে ১৯৩৬ সালে রিপাবলিকানদের বিরোধিতায় দাঁড়াল! তবে কী রিপাবলিকানদেরও দায় থেকে যায় না গৃহযুদ্ধ পরবর্তী স্পেনে জেনারেল ফ্রাঙ্কোর এই ফ্রাঙ্কেস্টাইন হয়ে দাঁড়ানোর পিছনে? বাস্তবত লেখক নিজেও সেই জটিল ইতিহাসের এক অংশ বলে বিষয়টিকে বিশ্লেষণ করা দুরূহ। তবুও আশ্চর্য নিরাসক্তিতে হোসে মেরিনো এই লেখা লিখে চলেছেন সমদূরত্ব নীতি নিয়ে।।
ইতিহাস ও বর্তমানের মিশ্রণে বারবার প্রশ্ন তুলেছেন পাঠকের সামনে। নাগরিকরা সকলেই কোন না কোন পন্থী ছিল না। আর একটি অংশ ছিল যারা জবাবদিহি চায় এই দুটি উগ্র মতবাদের সহ নাগরিকদের কাছেই। এই অংশ তুলে ধরছি।– "মার্কোসকে আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম যে ফ্রাঙ্কোর মৃত্যুর পর যে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হল তা কী সমস্ত স্পেনীয়দের সুসংহত করবে? প্রশ্নটা শুনে অবাক হয়ে সে আমার দিকে চাইল-
- কী বলছিস?... আমি জানি না মিলন ঘটবে কি না তবে প্রথম যা দরকার তা হল গৃহযুদ্ধের হোতা অথবা ওদের উত্তরাধিকারী দক্ষিণপন্থীদের ক্ষমা প্রার্থনা। বুঝতে পারছিস না এটা সাম্যের প্রশ্ন? না হলে ক্ষতের উপশম হবে না।
- - অন্যদিকে বামপন্থী বা তাদের উত্তরাধিকারীদের আতিশয্যের জন্যে, অপরাধের জন্যে, গোঁড়ামি এবং মাতব্বরির জন্য ক্ষমা চাইতে হবে। নইলে দেশের সর্বত্র বিষবৃক্ষের বীজ উত্তপ্ত হয়ে উঠবে"
এখানে একটি বিশেষ উল্লেখ্য বিষয় হল ঘৃণা। সেই কার্লোস যুদ্ধের জয়ী ও বিজিতের মধ্যেকার যে ঘৃণা ছিল তা শতবর্ষ পার হয়েও কীভাবে জীবন্ত ছিল তার প্রত্যক্ষ রূপ ধরা পড়েছে উপন্যাসের পাতায় পাতায়। ফিদেলের বয়ানে লেখক লিখে যাচ্ছেন ঘৃণা ও তার বিষাক্ত প্রভাবে নষ্ট হয়ে যাওয়া সমাজ। উপন্যাসে ফিদেলের জীবনে নারীর পর নারী পালটে পালটে যাচ্ছে সঙ্গ, কিন্তু মাথা থেকে বিলুপ্তি ঘটছে না তিক্ততার। বান্ধবীর সঙ্গে কফি খেতে খেতেও তার মনে পড়ছে - "ঐ যে হাইরোডগুলো ধরে যে গাড়ি ছুটে চলেছে, পশ্চাদপটে নিশ্চল নিসর্গ চিত্র- এসব জায়গায় জড়ো হল সেনাবাহিনী, যুদ্ধযান, উড়োজাহাজ, বারুদ। চল্লিশ কিলোমিটার বিস্তৃত ক্ষেত্রে কুড়িদিনব্যাপী যুদ্ধে নিহত হয় চল্লিশ হাজার যোদ্ধা। সমবেত বাহিনীর প্রায় অর্ধেক। চল্লিশ হাজার শরীরের কত লিটার রক্ত ছিল? তারা শুধু স্পেনীয় যোদ্ধা নন, আন্তর্জাতিক ব্রিগেডের স্বেচ্ছাসেবক ছিলেন, ইতালীয় স্বেচ্ছাসেবকদের উড়োজাহাজ ছিল, সমস্ত যুদ্ধটাই ছিল স্পেনীয় হিংস্রতার প্রকাস।
-আগামী তিরিশ মিলিয়ন বছরে ঐ যে পাহাড়্গুলো দাঁড়িয়ে আছে সেগুলি তেমন থাকবে না। অন্য পর্বতমালা সৃষ্টি হবে। পৃথিবীর শরীর তো বদলায়। দুই সময়কালের দুই গল্প। মানুষের জীবনযাপনে দুই পরস্পরবিরোধী আশ্চর্য ঘটনা আমাকে সংবেদনশীল করে তোলে, ধ্বংস আর সৃষ্টির বিচিত্র ধারা মানবিক সময় আর অ-মানবিক সময়ের চালচিত্র।"
লেখাটির মাঝে মাঝে চরিত্র হয়ে আসছেন ফিদেলের ডাক্তার ভালভের্দে। মানসিক অবসাদের চিকিৎসা করেন যিনি। আর আসছেন দোন কান্দিদাতো। নায়কের বয়ঃসন্ধির শিক্ষক। নিরন্তর নানান উপদেশ দিয়ে যান তিনি। নায়কের নানান মানসিক দোদুল্যমানতায়। অধ্যাপক ভেরাস্তেগি, যিনি ফিদেলের গবেষণার মেন্টর, তার সঙ্গেও কথোপকথন করে যায় ফিদেল। এই গবেষণা এক অর্থে চিকিৎসাও বটে।
মোন্তিয়েচোর গহবরে শেষ পর্যন্ত কী হয় সেকথা আর লিখলাম না। পাঠক পড়লেই জানতে পারবেন। উপন্যাস তবুও শেষ হয় এক সম্ভাব্য আশাবাদের দৃশ্য দিয়ে।
শ্রী তরুণ ঘটক বাংলা সাহিত্যের অনুবাদ জগতে এক শ্রদ্ধার নাম। দোন কিখোতের মত উপন্যাস অনুবাদ যার হাতে হয়েছে তাঁর যে কোন নূতন অনূদিত বইয়ের দিকে পাঠকের আগ্রহ থাকেই। হোসে মারিয়া মেরিনো এই মুহূর্তে স্পেনের রয়াল আকাদেমির সদস্য এবং দেশের প্রথম সারির একজন লেখক। সাধারণত সমসাময়িক বৃহৎ কলমগুলি বাংলায় পড়া অনেকটাই অসম্ভব। বাংলা বইয়ের জগতটি বিশ্ব মানচিত্রে ততখানি অর্থনৈতিক ভাবে শক্তিশালী নয় এখনও, এবং সে কারণে লেখকের অনুমতি পাওয়া দুরূহ হয়ে ওঠে। বন্ধুত্বের সুবাদে প্রয়োজনীয় অনুমতি নিয়েই হোসে মারিয়ার আরো একটি বই তরুণ বাবু করছেন। স্পেনীয় গৃহযুদ্ধ বা পরবর্তী ইউরোপীয় রাজনৈতিক বিষয়গুলি বাঙালি পাঠকের কাছে অনেকটাই অনাবিষ্কৃত। আগ্রহী পাঠকদের খিদে মেটানোর জন্য এ বই অনুবাদ করার জন্য নির্বাচিত হওয়া একটি ভাল সিদ্ধান্ত বলেই মনে করি।