বন্দুক দ্বীপ
বন্দুক দ্বীপ অনুবাদক অরুনাভ সিনহা প্রকাশক ওয়েস্টল্যান্ড বুকস প্রকাশিত ২০২১

শীতের ছুটি কলকাতায় কাটাতে এসে চারশো বছরের পুরনো রহস্যের হাতছানি। ক্লু বলতে সুন্দরবনের গভীরে একটি মন্দিরের গায়ে হায়ারোগ্লিফের মতো কিছু আঁকিবুঁকি, মাঝি মাল্লাদের মুখে ফেরা টুকরো গাথা আর একটি চেনা শব্দ – 'বন্দুক'।এই পর্যন্ত মনে হতেই পারে অমিতাভ ঘোষের সাড়াজাগানো নতুন উপন্যাস 'বন্দুক দ্বীপ' (অনুবাদ: অরুণাভ সিংহ) বোধহয় ইতিহাসভিত্তিক গোয়েন্দা গল্প।কিছুটা তাই।কিন্তু এই উপন্যাসের কেন্দ্রবিন্দুতে নেই সাবেকি কোনো ফেলু মিত্তির, তবে আছে মাফিয়া চক্র, আর গল্প জুড়ে রয়েছে বিশ্বপ্রকৃতি।বন্দুক দ্বীপের টানটান প্লটের নেপথ্যে রয়েছে মানবসভ্যতা ও প্রকৃতির চিড়ধরা সম্পর্কের আখ্যান যা বিশ্বায়নের নিয়ন আলোর আঁধারে হাড় হীম করা এক বিকট রূপে উপস্থিত হয়েছে।

দুর্লভ বই আর প্রাচীন দ্রব্যসামগ্রীর কারবারি ডীন দত্ত ব্রুকলিনের ঠান্ডা থেকে পালিয়ে কলকাতার বাড়িতে এসে রয়েছেন। সুন্দরবনের 'বাদাবন ট্রাস্টের' প্রতিষ্টাত্রী নীলিমা বসুর কাছে জানতে পারলেন এক `বন্দুকি সওদাগরের' কথা যার থান রয়েছে গভীর জঙ্গলে।ওই বণিককে জড়িয়ে অদ্ভুত সব কাহিনী ভেসে বেড়ায় যার কিছু, চাঁদ সওদাগরের কাহিনীর আদলের।কিন্তু কে ছিলেন ওই বন্দুকি সওদাগর আর কোথায় সেই দেশান্তরের বন্দুক দ্বীপ যেখানে, মনসা দেবীর রোষে পড়ে, তাকে আশ্রয় নিতে হয়েছিল?

এইসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতেই ডীন আমেরিকা ফেরার আগে পৌঁছলো সুন্দরবনে বন্দুকি সওদাগরের থানে যেখানে রহস্যের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বিপদ ওৎ পেতে রয়েছে।মাঝি হরেন নস্কর ছাড়াও পথে তার সঙ্গী ট্রাস্টের এক কর্মচারীর বখাটে ছেলে টিপু আর ওই থানের দেখাশোনা করা মুসলিম পরিবাবের শেষ জীবিত সদস্য, রফি।থানটির আরেক বৈশিষ্ঠ হলো হিন্দু মুসলমান ধৰ্মনির্বিশেষে এর ভক্ত – হিন্দুদের বিশ্বাস মনসা দেবী ধাম রক্ষা করেন আর মুসলামনারা বলেন ইলিয়াস পীর এর রক্ষাকর্তা।

অগাধ পান্ডিত্য, গভীর উপলব্ধি এবং প্রাণবন্ত চরিত্রায়ন এর উপর ভর করে বয়ে চলে বন্দুক দ্বীপ-এর ঝোড়ো হাওয়ার মত গল্প।কখন ভূতের রাজার বরে পাঠক পৌঁছে যায় দূর কোনো দেশে, শুরু হয় নতুন ঘটনা প্রবাহ আবার কোথাও অজানা, অচেনা পৃথিবী অন্ধকারে মুখ বাড়িয়ে থাকে, চরিত্র এবং পাঠকের সঙ্গে ফিসফিসয়ে কথা বলে যায়।

আমেরিকা ফেরত বখে যাওয়া টিপু, মানুষ-পাচার চক্রের দালাল।উষ্ণায়নের আঘাতে, দারিদ্রের জাতাকলে পড়ে জর্জরিত মানুষকে সে দেখায় পাশ্চাত্যের নিয়ন আলোর স্বপ্ন।
কিন্তু ডীনকে উত্যক্ত করতে করতে বন্দুকীর থানে চলে আসার পর সে নিজেই পড়ে চরম বিপদে।এক অতিকায় শঙ্খচূড়ের ছোবলে ধরাশায়ী টিপুকে তড়িঘড়ি তোলা হল নৌকোয়।

সওদাগরের থানে ওই কিং কোবরার আক্রমণের পর লুসিবাড়ির চিকিৎসাকেন্দ্রে নিয়ে যাওয়ার পথে টিপু প্রলাপ বকে। কে ওই `রানী' যার নাম সে ঘোরের মধ্যে উচ্চারণ করে? তার উত্তর পাওয়া যাবে গল্পের আরেক চরিত্র, সামুদ্রিক জীববিজ্ঞানী এবং বাদাবন ট্রাস্টের মূল কর্মকর্তা পিয়া রায়ের কাছে।

বন্দুকি সওদাগরের নির্জন থানে ওই ঘটনার দৃশ্য পড়তে গিয়ে গা ছম ছম করে।যেমন গায়ে কাঁটা দেয় গল্পের আরেক চরিত্র কারিসমাটিক ইতালিও অধ্যাপিকা চিন্তার সঙ্গে পথ দুর্ঘটনায় তার সদ্য প্রয়াত মেয়ে লুচিয়ার সাক্ষাতের বর্ণনা পড়ে।এই ধরণের আরো অনেক অদ্ভুত ঘটনা ছড়িয়ে রয়েছে এই উপন্যাস জুড়ে।

সাহিত্যে অদ্ভুতের প্রাধান্য আজকের কথা নয়।আরব্য রজনীর মতো জনপ্রিয় পুরোনো আখ্যানগুলি একের পর এক সাজানো অদ্ভুত, অকল্পনীয়, স্বল্প সম্ভানাময় (low probability) ঘটনার সমাহার।পরে এই ভাবে গল্প লেখা বিভিন্ন কারণে কমে আসে।ডীন দত্তর সঙ্গে রফির হঠাৎ ভেনিসে দেখা হওয়া এবং সেখান থেকে গল্পের নতুন মোড় নেওয়া এরকমই প্রায় অসম্ভব একটি ঘটনা।দিনের চরিত্র অন্তর্মুখী, সে যখন নিজের ভবিষ্যৎ নিয়ে গভীর চিন্তায় ডুবে যায় তখন সে চান্স আর প্রোবাবিলিটির হিসেব কষে।উষ্ণায়নের ঘটনাপ্রবাহে, তার বিকট রূপে, এই অসম্ভব, অস্বাভাবিক, অকল্পনিয়র (unimaginable) প্রভাবও লক্ষণীয়।বন্দুক দ্বীপ-এ অদ্ভুত ঘটনা সমাহার এবং চান্স ও প্রোবাবিলিটির সঙ্গে এই কাহিনীর গূঢ় সম্পর্ক, উষ্ণায়নের অকল্পনীয়র প্রেক্ষাপটকেই আরো মজবুত করে। সাহিত্যে আধুনিকতার একরকম শান্ত মৃদুমন্দ বাতাসের পর, বন্দুক দ্বীপ-এর ঝোড়ো হাওয়া পাঠককে নিশ্চিত আনন্দ দেবে।

উষ্ণায়নের থাবা মানব সভ্যতার ঔদ্ধত্যকে চুরমার করার সঙ্গে সঙ্গে সাহিত্যে এক নতুন ধারা ক্রমেই প্রবল হচ্ছে যার নাম দেওয়া হয়েছে ক্লাই-ফাই বা ক্লাইমেট ফিক্শন।অমিতাভ ঘোষ যদিও এই ধরনের লেবেল এর বিপক্ষে, তার এই উপন্যাসটিকে সহজেই উষ্ণায়ন-সাহিত্য বা ক্লাই-ফাই এর অন্তর্গত করা চলে।মনুষ্যসৃষ্ট গ্রীনহাউস গ্যাস থেকে পৃথিবীর জলবায়ু পরিবর্তনের ব্যাপারে এই উপন্যাস সর্বদা সচেতন তো বটেই এই বইটিতে রয়েছে গা ছম-ছম করা বা হাড় হীম করা কিছু দৃশ্যে যাকে গ্রেগরস আন্ডারসেনের মত ক্লাই-ফাই গবেষকরা বলছেন `আনক্যানি' (uncanny)।

আনক্যানির সঙ্গে আরেকটু পরিচয় করা যাক। উপন্যাসের শেষের দিকের একটি নাটকীয় মুহূর্তে দেখি পরিযায়ী পাখির দল, শুশুক, তিমি হঠাৎ সব একত্রিত হয়ে ইউরোপে কাজের সন্ধানে আসা পরিযায়ী মানুষের নৌকার সামনে ভিড় করেছে। ঘোষের দক্ষ্ বর্ণনায় এবং অরুনাভ সিংহর যত্নশীল অনুবাদে ওই দৃশ্যটি পাঠকের মনে শিহরণ জাগাতে বাধ্য।আবার ভেনিসে চিনতার বাড়িতে, ডীনের বিষাক্ত ব্রাউন রেকলিউজ মাকড়সার সঙ্গে সাক্ষাত অথবা ওই রিফিউজিদের সাহায্য করতে বেরিয়ে টর্নেডোর পাল্লায় পড়ার মতো বিরল, অস্বাভাবিক প্রায় অকল্পনীয়, মুহূর্তগুলিও এই বইয়ে ফিরে ফিরে আসে। পড়তে গায়ে কাঁটা দেয়, অদ্ভুত এক অস্থিরতা পাঠককে গ্রাস করে:

" …ওরা এসে পড়ল, কোটি কোটি পাখি, মাথার ওপর ঘুরছে, আর একই সময়ে নীল নৌকার পাশে ঝাঁকে ঝাঁকে শুশুক ডিগবাজি খাচ্ছে, তিমিরা লেজ দিয়ে জলে আছাড় মারছে।
`উনো স্তরমো' চিনতা উপর দিকেই তাকিয়ে বলল।উড়ন্ত পাখির ঝাঁকের ইতালীয় বর্ণনাটাই যথাযত মনে হলো আমার, আমরা যা দেখেছি তার জন্য একমাত্র এই কথাটাই প্রয়োগ করা যেতে পারে, ঝড় উঠেছে, জীবন্ত প্রাণীর, ভূতের।"

চেনা পৃথিবী যেন ক্রমেই অজানা অচেনা হয়ে ওঠে।দার্শনিক হেইডেগার এবং ফ্রয়েডের লেখায় বিভিন্ন প্রসঙ্গে এই আনক্যানির আলোচনা রয়েছে।হেইডেগারের শিষ্য হারমান স্মিটজ এই বিষয়টিকে আরো পরিষ্কার করে বর্ণনা করেন যার সাহায্যে গবেষক গ্রেগরস অ্যান্ডারসন আনক্যানির সঙ্গে ক্লাইমেট উপন্যাসের একটি যোগসূত্র খুঁজে পেয়েছেন।তার মতে উষ্ণায়নক্লিষ্ট পৃথিবীর পরিবর্তিত রূপ মানুষের মনে যে উদ্বেগ, আশঙ্কা তৈরী করে সেই অনুভূতির সঙ্গে বাহ্যিক জগতের অচেনা, ভীতিপ্রদয়াক চেহারার সংমিশ্রনেই আনক্যানির উদ্ভব।জার্মানে যাকে বলা হয় das unheimlich (the unhomely) অর্থাৎ চেনা বাসস্থান আর চেনা যায় না।

গল্পের শেষের দিকে অদ্ভুত আবহাওয়ার সম্মুখীন হয় ডীন, চিনতা, পিয়া এবং অন্যান্যরা । প্রথমে ভেনিস এ অস্বাভাবিক শিলাবৃষ্টি তারপর পথে হঠাৎ ভয়ঙ্কর টর্নেডোর আবির্ভাব। প্রকৃতি যেন ক্ষেপে উঠে মানুষের ওপর বদলা নিতে উদ্যত।

" … পরমুহূর্তে মাটি কেঁপে উঠল, যেন বিরাট ওজনের কোনো বস্তুর আঘাতে।
মাথা তুলে দেখি ঘূর্ণিবাত অল্পের জন্য আমাদের রেহাই দিয়েছে, কুড়ি গজ সামনে রাস্তা পেরিয়ে একটা গাছ উল্টে দিয়ে চলে গেছে।
এরপর সমস্ত আওয়াজ থেমে গিয়ে ভুতুড়ে, থমথমে নিস্তব্ধতা নেমে এল।বুঝতে পারলাম ঘূর্ণিবাত মাটির সাথে যোগাযোগ হারিয়ে আবার ছিটকে আকাশে উঠে গেছে কিন্তু চারপাশে এত ধুলো-মাটি-পাতা উড়ছে যে মনে হচ্ছে রাত নেমে এসেছে। …
তারপর হেডলাইটের আলোয় দেখতে পেলাম গাছের গুঁড়ির ওপাশে কিছু একটা নড়ছে, ধুলোর মধ্যে দিয়ে অপার্থিব অপচ্ছায়ার মত এক মূর্তি আবির্ভূত হয়েছে।"

এই ধরণের দৃশ্যে রয়েছে ফ্রয়েডিও আনক্যানির ছায়া। ফ্রয়েডের লেখায় অবদমিত মনশ্চিত্র (repressed fantasy) জড় বস্তুর মধ্যে যেন প্রাণ সঞ্চার করে, যা দেখে আমাদের মনে ভয় এবং গায়ে কাঁটা দেওয়া এক `আনক্যানি' অনুভূতি হয়।গবেষকদের মতে ক্লাইমেট উপন্যাস বা সিনেমার (যেমন ইনটু টি স্টর্মে পিটের মৃত্যুদৃশ্য) ক্ষেত্রে পার্থক্য হল টর্নেডো, শিলাবৃষ্টি বা সাইক্লোনের দাপট অবদমিত মনশ্চিত্রের প্রকাশ নয় বরং মানুষের জড় জগতের ওপর আধিপত্যের সমাপ্তির ইঙ্গিতবহ।এখানে অবদমিত জড়বস্তু মানবজাতির লোভে দূষিত, সংক্রমিত হয়ে যেন বিকট রূপ ধারণ করে বস্তুনির্ভর প্রগতির দম্ভকে চুরমার করে দিতে চায়।

অরুনাভ সিংহের সাবলীল অনুবাদে, মূল ইংরেজির মতো বাংলাতেও এই উপন্যাস একই রকম আকর্ষণীয়। বইটিতে ব্যবহৃত বৈজ্ঞানিক পরিভাষা, বিদেশী শব্দ, ইত্যাদিকে সহজ বাংলায় পাঠকের সামনে তুলে ধরার জন্য অনুবাদকের মুনশিয়ানার তারিফ করতেই হবে। গল্পের চরিত্ররা অনেকেই বাংলার মানুষ, গল্পের পটভূমিতেও পশ্চিমবঙ্গ এবং বাংলাদেশ অনেকটা জায়গা জুড়ে আছে, আর লেখক নিজেও বাঙালি, ফলে এই বইয়ের বাংলা অনুবাদ যথাযত। বিষয়ের গুরুত্বে আর পশ্চিমবঙ্গ এবং বাংলাদেশে উষ্ণায়নের প্রকোপের্ উত্তরোত্তর বৃদ্ধির কারণেও, এই উপন্যাসটি গুরুত্বপূর্ণ।

বন্দুক দ্বীপের গল্পের শুরু কলকাতা ও সুন্দরবনে হলেও খুব তাড়াতাড়ি প্রেক্ষাপট বদলে যেতে থাকে – ব্রুকলিন, ক্যালিফোর্নিয়া, ভেনিস, ভূমধ্যসাগর এবং অন্যত্র।দাবানল, সাইক্লোন, পরিযায়ী মানুষের বিপদসংকুল যাত্রা সব কিছুই গল্পের পরতে পরতে উষ্ণায়নের পদচিহ্ন রেখে যায় এবং পাঠক বুঝতে পারেন এই পৃথিবিব্যাপী সংকট কিভাবে ইতালির সঙ্গে ভারতবর্ষ, আমেরিকার সঙ্গে ইউরোপ, ভূমধ্যসাগরের সঙ্গে বঙ্গোপসাগরকে মিলিয়ে দেয়।বোঝা যায় কেনো এই সময়ের গল্পে, দূর আর নিকট, চেনা আর অপরিচিত সব মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়।

বন্দুকি সওদাগরের ৪০০ বছরের আগের দেশান্তরের যাত্রায় যেন আজকের উষ্ণায়নের সমস্যার ছায়া দেখতে পাই।হিসেব করলে দেখা যায় ওই সময়ে ক্ষুদ্র হিম যুগের কারণে পৃথিবীর জলহাওয়ায় বিরাট পরিবর্তন ঘটেছিল যা অনেকাংশে আজকের উষ্ণায়ন ঘটিত দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার সঙ্গে তুলনীয়। ঝড়, ঝঞ্জা, জলদস্যুর কবল থেকে বেঁচে গল্পের ওই বণিককে এক দেশ থেকে অন্য দেশে পালিয়ে বেড়াতে হয়েছিল যতক্ষণ না সে মনসা দেবীকে সন্তুষ্ট করে।ওই লোকগাথায় সর্পদেবী যেন `জড়' পৃথিবীর মুখপাত্র হয়ে সওদাগরকে বার বার সাবধান করে দেয়।

ডীন ব্রুকলিন ফিরে যাওয়ার আগে পিয়ার থেকে জানতে পারে `রানি' একটি শুশুকের নাম এবং তার পরেই সেই শুশুকের দলকে ডাঙায় মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়। জিপিএস এলার্ট বলে দেয়, যে সময়ে এই ঘটনা ঘটেছে টিপুর প্রলাপে রানীর নাম প্রায় সেই সময়েই উচ্চারিত হয়েছিল।সাপের কামড়ে মৃতপ্রায় টিপু কিভাবে রানীর বিপদের কথা বুঝতে পারে? অথবা ইতিহাসবিদ চিনতা মেয়ের মৃত্যুর খবর পাওয়ার আগেই কেন মেয়েকে দেখতে পায়?

আবারো সেই মানুষের সঙ্গে মানুষ ভিন্ন অন্যদের (other than human) যোগাযোগ ঘটে যাওয়ার বিবরণ।কখনো তা দেবীর মাধ্যমে কখনো আবার সাপে কাটা মানুষের প্রলাপে। লিজ জেনসেনের ক্লাইমেট উপন্যাস `দ্য র‍্যাপচার' এও দেখতে পাই উন্মাদাগারে থাকা এক বালিকার ভবিষ্যৎবাণীতে ফুটে ওঠে মানুষের লোভে জর্জরিত পৃথিবীর আর্তনাদ।এইভাবেই মানুষ বাদে বাকিরা তাদের কথা আমাদের কাছে পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করে চলে।

শুরুর দিকে ক্লাইমেট উপন্যাসে ডিস্টোপিয়া আর নৈরাশ্যের প্রাধান্য ছিল বেশি এবং অনেক ক্ষেত্রেই এই গল্পগুলির প্রেক্ষাপট হত ভবিষ্যতের পৃথিবী।আমি নিজের ক্লাইমেট উপন্যাস 'দ্য বাটারফ্লাই এফেক্ট'-এ এই ডিস্টোপিয়াকেই অনেক অংশে প্রাধান্য দিয়েছিলাম।ক্রমে আরো নানা ভাবে এই ক্লাইমেট-কাহিনী লেখা হয়েছে এবং বর্তমানে আশাবাদী, কিছুটা ইউটোপিয়ান, ক্লাই-ফাইয়ের (যেমন `সোলারপাঙ্ক') একটি ধারাও লক্ষ্য করা যাচ্ছে।বন্দুক দ্বীপ উপন্যাসের বিষয় আজকের জগৎ, আবার এই বইটিকে ডিস্টোপিয়া অথবা তার উল্টোপিঠের ইউটোপিয়া ঘরানায় ফেলা চলে না কারণ এই দুইয়েরই উপাদানই গল্পটিতে আছে।

সাইক্লোন পরবর্তী সুন্দরবনের চেহারায়, আন্তর্জাতিক পাচারচাকরীদের নৃশংসতায়, অথবা ক্যালিফোর্নিয়ায় প্লেন থেকে দেখা দাবানলের বর্ণনায় যেমন রয়েছে ডিস্টোপিয়ান গল্পের লেশ অন্যদিকে পরিযায়ীদের সাহায্যার্থে এগিয়ে আসা একদল মানুষের যৌথতায় দেখতে পাই প্রতিরোধস্প্রীহা, দেখি আশার স্ফুলিঙ্গ।আবার গল্পে ভূত রয়েছে, রয়েছে প্রায় অলৌকিক, অস্বাভাবিক সব ঘটনা।বাস্তববাদী কাহিনী হয়েও এইসব অকল্পনীয়, ভৌতিক, অস্বাভাবিক কাণ্ডকারখানার জন্যই কেউ কেউ এই ধরনের লেখাকে 'রিয়ালিস্ট-হাইব্রিড' ক্লাই-ফাই, অর্থাৎ বাস্তব আর অকল্পনীয়র মিশ্রণ হিসেবে দেখেছেন।

লেখক নিজেই একটি ইন্টারভিউতে বলছেন তিনি ভবিষ্যতের ডিস্টোপিয়া নয়, এই সময়ের উষ্ণায়নক্লিষ্ট পৃথিবীর গল্পই লিখতে চেয়েছেন। উষ্ণায়ন সম্পর্কে তার দীর্ঘ প্রবন্ধ সংগ্রহ `দ্য গ্রেট ডিরেঞ্জমেন্ট: ক্লাইমেট চেঞ্জ অ্যান্ড দ্য আনথিঙ্কেবল '- এর নানান চিন্তা ভাবনাই গল্পের আকারে সাজাতে চেয়েছেন `বন্দুক দ্বীপ' উপন্যাসে।

গল্প যত এগিয়েছে, ঘটনা প্রবাহ টিপু ও রফিকে সুন্দরবন থেকে টেনে নিয়ে গেছে বহু দূরে।ভয়ঙ্কর বিপদও তাদের পিছু ছাড়তে চায় নি।ক্রমে যেন বন্দুকি সওদাগরের আখ্যান আর ওদের গল্প একই খাতে বইতে চেয়েছে। কোন দিকে বইবে সেই নদী – শেষে কি জুটে যাবে কিছু বন্ধু? ডীন আর চিনতা কি উদ্ধার করতে পারবে বন্দুকি সওদাগরের থানের ওই অদ্ভুত হায়ারোগ্লিফের রহস্য? আজকের এই ভাঙা সময়ের আঁধারে এসে সুনিপুন গবেষণা এবং টানটান উত্তেজনার এই উপন্যাসটি অবশ্যই পড়তে হবে।